কবুতর: কিভাবে তারা খুঁজে পায় চিঠিতে লেখা ঠিকানা? রাজ-রাজরাদের যুগে দামামার বাদ্যে রক্তক্ষয়ী রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের দ্রুততম সময়ে গোপন বার্তা পৌঁছানোর অবলম্বন ছিলো কবুতর বা পায়রা। ডাকহরকরার ভূমিকায় অবতীর্ণ এই কবুতরকে বলা হয় বাহক কবুতর। প্রাকৃতিক অভিযোজনের অভিনব ক্ষমতা ব্যবহার করে কবুতর খুঁজে নিয়েছে তার সঠিক গন্তব্য।বাহক কবুতর পরিচিতিবাহক কবুতর (Carrier Pigeon) হোমিং কবুতর (Homing Pigeon) কিংবা ডাক কবুতর (Messenger Pigeon) নামেও পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম Columba livia domestica। এদেরকে পোষা প্রাণী হিসেবে পালন করা হয়।এরা সাধারণত মানুষের তৈরি লফট (Loft) বা খাঁচায় বসবাস করে, কিন্তু মুক্ত অবস্থায় যেকোনো অঞ্চলে উড়তে পারে। যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই কবুতর ঠিকানা চিনে চিঠি বহনের উপযোগী হয়ে ওঠে। কবুতর সাধারণত শস্য, বীজ, ফল এবং ছোট পোকামাকড় খায়। এরা সাধারণত ১০০০ কিলোমিটার (৬২০ মাইল) পর্যন্ত দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। তবে কিছু কবুতর আরও বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে সক্ষম। কবুতরের গড় গতি ঘণ্টায় ৫০ থেকে ৬০ মাইল (৮০ থেকে ৯৭ কিলোমিটার) হতে পারে।কবুতরকে চিঠির বাহক হিসেবে ব্যবহারের ইতিহাস বেশ প্রাচীন এবং এটি মানব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।প্রায় ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বে প্রাচীন মিশর ও পারস্যে কবুতরকে বার্তাবাহক হিসেবে ব্যবহার করা হতো। মিশরীয়রা বিশেষ করে রাজকীয় আদেশ পাঠানোর জন্য কবুতর ব্যবহার করত। গ্রিস ও রোমান সভ্যতায়ও কবুতরকে সামরিক ও বেসামরিক বার্তা প্রেরণের জন্য ব্যবহার করা হত। গ্রিসে অলিম্পিক গেমসের বিজয়ীদের নাম দ্রুত ছড়িয়ে দিতে কবুতর ব্যবহার করা হতো। মধ্যযুগে ইসলামিক বিশ্বে কবুতরকে বার্তা প্রেরণের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হত। বিশেষ করে খলিফা ও শাসকরা তাদের দূরবর্তী প্রদেশগুলির সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য কবুতর ব্যবহার করতেন। ইউরোপেও বাণিজ্যিক ও সামরিক উদ্দেশ্যে কবুতরকে বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হত। নেপোলিয়ন তার সেনাবাহিনীর মধ্যে যোগাযোগের জন্য কবুতর ব্যবহার করতেন। আধুনিক যুগের শুরুতে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কবুতরকে সামরিক বার্তা প্রেরণের জন্য ব্যবহার করা হত। কবুতরগুলি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দ্রুত সদর দপ্তরে পৌঁছে দিত।যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কবুতর বেছে নেয়ার কারণ১. দ্রুতগতি: কবুতর খুব দ্রুত উড়তে পারে এবং দূরবর্তী স্থানে দ্রুত বার্তা পৌঁছে দিতে পারে। এটি বিশেষ করে যুদ্ধের সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।২. নির্ভরযোগ্যতা: কবুতর তাদের গন্তব্যে নির্ভরযোগ্যভাবে পৌঁছাতে পারে। তারা তাদের বাসস্থানে ফিরে আসার জন্য প্রাকৃতিক অভিযোজন ক্ষমতা ব্যবহার করে।৩. সহজলভ্যতা: কবুতর সহজলভ্য এবং এদের পালন করা সহজ। এদের খাদ্য ও যত্নের প্রয়োজনীয়তা তুলনামূলকভাবে কম।৪. নিরাপত্তা: কবুতরের মাধ্যমে বার্তা প্রেরণ করা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ছিল। কবুতরকে ধরা বা বার্তা আটকানো কঠিন ছিল।৫. দূরবর্তী যোগাযোগ: প্রাচীন ও মধ্যযুগে দূরবর্তী স্থানে যোগাযোগের অন্য কোনও কার্যকর মাধ্যম না থাকায় কবুতর ব্যবহার করা হত।কবুতর যেভাবে তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছায়কবুতরের একটি প্রাকৃতিক অভিযোজন ক্ষমতা রয়েছে, যা তাদের বাসস্থান থেকে দূরে গেলেও ফিরে আসতে সাহায্য করে। কবুতরের শরীরে রয়েছে জিপিএস সিস্টেমের মতো ক্ষমতা। তারা সূর্য, চাঁদ, তারকা এবং পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের সাহায্যে দিক নির্ধারণ করতে পারে। গবেষকদের মতে, কবুতরদের দেহে ৫৩ ধরণের বিশেষ সংবেদনশীল কোষ থাকে, যার কারণে তারা পথ ভুল করে না। ম্যাগনেটোরিসেপশনের মাধ্যমে তারা পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র শনাক্ত করতে পারে। এটির সাহায্যে তারা দিকনির্ণয় করতে পারে। কবুতরকে নির্দিষ্ট স্থানে চিঠি পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণের সময়, কবুতরকে বারবার একই রুটে উড়ানো হয় যাতে তারা রুটটি মনে রাখতে পারে। কবুতরের স্থানিক স্মৃতি খুব শক্তিশালী। তাদের চোখের রেটিনায় বিশেষ একধরনের প্রোটিন রয়েছে। চমৎকার দৃষ্টিশক্তির অধিকারী হওয়ায় তারা তাদের উড়ানের পথে বিভিন্ন ল্যান্ডমার্ক (যেমন পাহাড়, নদী, বিল্ডিং) মনে রাখে এবং এই ল্যান্ডমার্কগুলির সাহায্যে তাদের গন্তব্যে পৌঁছায়। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে কবুতর তাদের ঘ্রাণশক্তির সাহায্যেও পথ চিনতে পারে। তারা বাতাসে ভেসে আসা বিভিন্ন গন্ধের সাহায্যে তাদের গন্তব্য নির্ধারণ করতে পারে।ইতিহাসে বেশ কিছু বিখ্যাত বাহক কবুতর রয়েছে যেগুলো জীবনরক্ষায় অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জন করেছে। বিশেষ করে যুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ বার্তা প্রেরণে এই কবুতরগুলোর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯১৮ সালে, চের অ্যামি "লস্ট ব্যাটালিয়ন" নামে পরিচিত একটি আমেরিকান ইউনিটের ১৯৭ জন সৈনিকের জীবন রক্ষা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৩ সালে, জি.আই. জো ইতালির একটি গ্রামে ব্রিটিশ সৈন্যদের জীবন রক্ষা করে। গ্রামটি ধ্বংস করার জন্য বিমান হামলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু জি.আই. জো বার্তাটি পৌঁছে দিয়ে হামলা বন্ধ করে দেয়। ১৯৪৪ সালে, প্যাডি নামক একটি কবুতর নরম্যান্ডি আক্রমণের সময় বার্তা প্রেরণ করতো।২০ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে রেডিও, টেলিগ্রাফ, টেলিফোন ও ইন্টারনেটের আবির্ভাবে কবুতর ডাকের ব্যবহার কমে যায়। বর্তমানে এটি প্রতীকী, প্রতিযোগিতামূলক কাজে এবং গবেষণায় ব্যবহৃত হয়।